ব্যবসা করতে এসে হয়ে ওঠেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখ্যাত রাজা

পানিপথ থেকে বাংলায় এসেছিলেন মূলত ব্যাবসা করার উদ্দেশ্য নিয়ে পলাশির যুদ্ধের ঠিক পরে। তিনি ব্যবসায় বিশেষ প্রতিপত্তি করতে না পেরে মুর্শিদাবাদের রাজস্ব আদায়ের দেওয়ান রেজা খাঁর সাথে সখ্যতা এবং ওয়ারেং হেস্টিংস এর বিশেষ প্রিয় পাত্রে পরিণত হন ।

ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন ওপরের লিঙ্কে

মুর্শিদাবাদ। এই নামটার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। যে শহরের প্রত্যেকটা ইটে কাঠে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর যুদ্ধের তীব্র চিৎকার। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করলে, মুর্শিদাবাদ উন্নতির পথে চড়তে থাকে তরতর করে। সালটা ১৭৫৭। পলাশির যুদ্ধের ঠিক পর। রাজা দেবী সিংহ পানিপথ থেকে বঙ্গে আসেন ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে। পরে ব্রিটিশদের আনুগত্য পেয়ে ট্যাক্স কালেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং সেই কাজ তিনি কিভাবে সম্পন্ন করেন, তিনি কেন বাংলায় থেকে যান এবং কিভাবে নশিপুর রাজবাড়ি স্থাপন করেন তা জানবো আজকের এই পর্বে। 

 

মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখ্যাত রাজা দেবী সিংহ সুদূর পানিপথ থেকে বাংলায় এসেছিলেন মূলত ব্যাবসা করার উদ্দেশ্য নিয়ে পলাশির যুদ্ধের ঠিক পরে। তিনি ব্যবসায় বিশেষ প্রতিপত্তি করতে না পেরে মুর্শিদাবাদের রাজস্ব আদায়ের দেওয়ান রেজা খাঁর সাথে সখ্যতা এবং ওয়ারেং হেস্টিংস এর বিশেষ প্রিয় পাত্রে পরিণত হন । কালক্রমে ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁকে রাজস্ব সংগ্রাহকের কাজের জন্য সুপারিশ করেন । রংপুর ও দিনাজপুরের রাজস্ব আদায়ে নিযুক্ত হন । এই খাজনা আদায়ে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্মম আর ভীষণ অত্যাচারী । তাঁর অত্যাচারের কথা ওই এলাকার মানুষের মনে এখনো আতঙ্কের ছাপ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। উপযুক্ত স্বাস্থ্য ও কুরুপ দর্শনের জন্য ভীতু প্রজাবর্গ তাকে মহিষাসুর আখ্যা দিয়েছিলেন।


দেবী সিংহকে পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজা উপাধি প্রদান করেন, এবং তিনি নশিপুর রাজবাটির প্রতিষ্ঠা করেন পরে তিনি মহারাজাও হন । তিনি নি:সন্তান ছিলেন তাই তাঁর পরবর্তীতে ভ্রাতুষ্পুত্র রাজা উদমন্ত সিংহ নশিপুরের রাজা হন। তিনি বহু মন্দির নির্মান করেছিলেন পূর্ব পুরুষদের পাপ মোচনের জন্য । তাঁর জমিদারির অধিকাংশ আয় দেবতা , ব্রাহ্মণ ও দরিদ্র মানুষের সেবায় ব্যয় করতেন।



রাজা উদমন্ত সিংহের নাতি রাজা কীর্তিচাঁদ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে হাজারদুয়ারীর আদলে বর্তমান নশিপুর রাজবাড়িটি নির্মান করেছিলেন । এই রাজ এস্টেট বাংলার অন্যতম জমিদারি ছিল । মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম, নদিয়া, মালদহ, রাজশাহি, পাবনা ও বগুড়া জেলার কিছু জায়গা এই জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয় । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এক সভায় এই রাজপরিবারকে বংশানুক্রমিক 'রাজা বাহাদুর' উপাধি দেওয়া হয় ।



এই রাজবাড়িটি কালের অতলে তলিয়ে যেতে বসেছিল। বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রৌঢ় সদস্য সৌরেন্দ্রমোহন সিংহ জানালেন, মন্দির, নাটমন্দির, রাজবাড়ী মিলে মোট আয়তন প্রায় ২০ বিঘা। সেখানে ৭০টি ঘর সম্বলিত অন্দরমহল ছিল। কিন্তু জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক অনটনে সংস্কার করা যায়নি। তার ফলে ওই বিশাল অন্দরমহল আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। ওই পরিণতি থেকে অবশিষ্ট রাজপ্রাসাদ ও মন্দির বাঁচাতে নশিপুরের পাঁচ জন যুবককে সম্পত্তির শতকরা ৮০ ভাগ ৬০ বছর লিজে দেওয়া হয়েছে। বাকি ২০ ভাগ রাজপরিবারের হাতেই রয়েছে। অর্থাৎ ওই পাঁচ জন এবং রাজপরিবারের সদস্য মিলে যৌথভাবে রাজবাড়ী সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষণ করার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সঙ্গে রয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার বিশিষ্ট কারু ও চিত্রশিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। শুধুমাত্র ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাই নয়, লালবাগের পর্যটন শিল্প সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁরা। কয়েক মাসের চেষ্টায় ভাঙাচোরা রাজপ্রাসাদের ভোল পাল্টে ফেলেছেন এবং সংস্কারের ফলে জরাজীর্ন দশা কাটিয়ে উঠে প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন নশিপুর রাজবাড়িটি এখন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।



পর্যটকদের উদ্দেশ্যে রাজবাড়ী ও মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্থায়ী আর্ট গ্যালারি করার জন্য বিনাভাড়ায় পঞ্চাননবাবুকে দু'টি ঘর দেওয়া হয়েছে। চক, মাটি, এলুমিনিয়ামের তার ও টুকড়ো, কাগজের মণ্ডের তৈরী বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী ছাড়াও ওই গ্যালারিতে রয়েছে প্যাস্টেল, অয়েল পেইন্টিং ও স্কেচের প্রায় ৫০টি চিত্রকর্ম। খুলে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক নাটমন্দির সহ আট বিঘা এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হনুমান মন্দির, কালী মন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ। রয়েছে ডাইনিং রুমের দেওয়ালের পাশে মেঝের ওপর মেহগনি কাঠের কারুকার্যময় ৮ ফুট উচ্চতার 'গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক'। আরও আছে নিমকাঠের তৈরী দুশো বছরের প্রাচীন বিশালাকৃতির দেবদেবীর কয়েকডজন মূর্তি, ৬ফুট উচ্চতার কাঠের তৈরী রামগরুড়ের বিস্তৃত দু'টি দানার ওপর অধিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণের যুগলমূর্তী। মুর্শিদাবাদ পুরসভার ১৪ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত নশিপুর রাজবাড়িটি বর্তমান পর্যটন শিল্পে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে।



তথ্য সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, মুর্শিদাবাদ নবাব ও নবাবি - ফজলুল হক, মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি - কমল বন্দ্যোপাধ্যায়,    মুর্শিদাবাদ কাহিনী - শ্রী নিখিল নাথ রায়








Comments

Popular posts from this blog

হারানো এক জয় সেবাস্টিয়ান আর কলকাতার গপ্পো ❤️

জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ১৭২ বছর

৩ মাস ধরে জ্বলেছিল এই পৃথিবী সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯তলা গ্রন্থাগার!