গল্প নয়, সত্যি! লটারির টাকায় তৈরি হয়েছিল আজকের কলকাতা

লটারি খেলার টাকা থেকেই তৈরি হল যত কিছু বড় রাস্তা, বড় বড় বাড়িঘর। যেমন টাউন হল, স্ট্যান্ড রোড ওয়েলিংটন স্কয়ার, কলেজস্ট্রিট, আমহাস্ট স্ট্রিট। 


পলাশীর যুদ্ধ হয়ে গেছে। ইংরেজরা তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ান। ভালো করে দেশটাকে চালাতে গেলে তো একজন গভর্নরের দরকার। ক্লাইভ গেছেন স্বদেশে। গভর্নর করা হলো মিস্টার ভেরলেস্টকে। তারপর জন কার্টিয়ার। দুজনের কেউই খুব একটা যোগ্য লোক নয়। আরো বুদ্ধিমান আরো বিচক্ষণ কাউকে চাই। তেমন কে আছে চলল খোঁজখবর। নজর পড়লো হেস্টিংস এর দিকে।আর তারপর টানা ১৩ বছর চালিয়েছিলেন তার রাজত্ব। একা দায়িত্ব নিয়ে তৈরি করেছিলেন প্রাসাদ নগরী আজকের কলকাতা।



১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ এই ১৩ বছর জুড়ে হেস্টিংস বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। ফরাসি ভাষায় ছিলেন পন্ডিত। বহুদিন কেটেছে কাশিমবাজারে, তাই দেশি চালচলন আচার-আচরণ ধাতস্থ। পলাশীর পর মীরজাফরের রাজদরবারে তিনি ছিলেন রেসিডেন্ট।তার আমলেই 76 এর মন্বন্তর। তার আমলেই মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি। আমোদ-আহ্লাদ, বিলাসিতা, বাবুগিরি চরম সেও তার আমলে।



টলি নালা পেরিয়ে আলিপুরে হেস্টিংস এর বিলাস বহুল গৃহ। আরো অনেক বাগানবাড়ি ছিল। লর্ড কার্জন বলে গেছেন মোট ১৩ টা বাড়িতে বাস করেছেন হেস্টিংস।তাঁর আমল থেকেই কলকাতার বার বারন্ত। ইতিহাসের পাতায় হেস্টিংস মানুষটা সম্বন্ধে অনেক অভিযোগ আছে। বিলাসী, বেহিসাবি, লোভী কিন্তু কলকাতার উন্নতির জন্য তার অবদানের সীমা নেই। ভারতবর্ষের প্রাচীন শিল্পকে আর মত কেউ ভালোবাসেনি আর। ভারতের শিল্প সম্পদকে অন্ধকারের আড়াল থেকে আলোয় তুলে আনতে তার মতন আগ্রহ আর কেউ দেখায় নি।



1772 থেকে 1785 এই ছিল তার রাজাগিরির কাল। ১৩ বছর একটানা রাজাসাজার কৃতিত্ব একমাত্র তাঁর। প্রথমে ছিলেন বাংলার গভর্নর। তারপর গভর্নর জেনারেল। ১৭৭৩ এ হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ কে বাদ দিয়ে কলকাতাকে বানালেন বাংলার রাজধানী। কলকাতার উন্নতি চাই। হেস্টিংস চালু করলেন লটারি খেলা। লটারি খেলার টাকা থেকেই তৈরি হল যত কিছু বড় রাস্তা, বড় বড় বাড়িঘর। যেমন টাউন হল, স্ট্যান্ড রোড ওয়েলিংটন স্কয়ার, কলেজস্ট্রিট, আমহাস্ট স্ট্রিট। 


বাংলাদেশে প্রথম যে ছাপাখানা তৈরি হলো সে ও হেস্টিংসের প্রাণপন আগ্রহে। হলহেড নামে এক সাহেব ছিলেন কোম্পানির সিভিলিয়ান। বাংলা ভাষাটা কি করে যেন রপ্ত করেছিলেন বেশ। তিনি এক বই লিখে ফেললেন হঠাৎ। বাংলা ব্যাকরণের বই। কিন্তু না ছাপলে সে বই পড়তে পাবে কজন অথচ ছাপা যে হবে বাংলা হরফ কই।


হেস্টিং হাঁক দিলেন চার্লস উইলকিনস নামে আরেক সিভিলিয়ানকে। উইলকিনস ও খুব পন্ডিত লোক। হেস্টিংস এর অনুরোধে ভাগবত গীতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তিনি বাংলাতেও বিদ্বান। হেস্টিংস তাকে ধরে বসলেন যেমন করে পারো বাংলা হরফ বানাও।উইলকিনস ছাপাখানা খুললেন হুগলিতে। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন একজন দক্ষ বাঙালি নাম পঞ্চানন কর্মকার। উইলকিনসের বুদ্ধি ও চেষ্টায় আর পঞ্চানন কর্মকারের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফসল হিসাবে বাংলাদেশ পেল প্রথম বাংলা বই ছাপার হরফ।

 

হেস্টিংস এর আমলের আরেকজন বিখ্যাত লোকের নাম আমাদের মনে রাখা উচিত। তিনি স্যার উইলিয়াম জোন্স।এমনিতে সুপ্রিম কোর্টের জর্জ কিন্তু ইংরেজ হলে কি হবে ভারতবর্ষের এবং এশিয়ার শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি এক কথায় প্রাচ্যবিদ্যা সম্পর্কে তিনি ছিলেন দস্তুর মত আগ্রহী পন্ডিত। সংস্কৃত ও আরবি এই দুই ভাষায় আর আইন শাস্ত্রে তার জ্ঞান ছিল গভীর। এশিয়াটিক সোসাইটি তৈরি করেছিলেন তিনিই। জোন্স সাহেব ছিলেন গোটা কলকাতা শহরের সমস্ত শিক্ষিত মানুষের কাছে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ।


১৭৯৪ সালে তিনি যখন মারা গেলেন তার শোকযাত্রায় এত ভিড় হয়েছিল যার তুলনা ছিলনা তখন। সম্ভ্রান্ত আর সাধারণ সবাই মিশে গিয়েছিল সেই ভিড়ে। যত তার বয়স ততবার তোপের ধ্বনি করা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে।


হেস্টিংসের পর নতুন গভর্নর জেনারেল হলেন লর্ড কর্নওয়ালিস তারপরে ওয়েলেসলি। সেটা ১৭৯৮ সাল।

২ বছর পরেই নতুন শতাব্দী ঊনবিংশ শতাব্দী নবজাগরণের আলোয় প্রাসাদ নগরী কলকাতা, রাঙা হয়ে উঠতে লাগলো দিনের পর দিন। তারপরের ইতিহাস শোনাবো অন্য এক পর্বে।


Comments

Popular posts from this blog

হারানো এক জয় সেবাস্টিয়ান আর কলকাতার গপ্পো ❤️

জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ১৭২ বছর

৩ মাস ধরে জ্বলেছিল এই পৃথিবী সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯তলা গ্রন্থাগার!