মীরজাফর কি বাধ্য হয়েছিলেন পলাশির ষড়যন্ত্র করতে? প্রথম পর্ব

 নবাব আলীবর্দী খানের কাছে কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন সৈয়দ মীর জাফর আলী খান। নবাবের নাতির কোন ক্ষতি তিনি হতে দেবেন না। কিন্তু সেই মীর জাফর আলী খান কেন শপথ ভঙ্গ করলেন? 



                     


মীরজাফর। বাংলায় মীরজাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। এখনও ওই নাম বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ। শুধু বাংলার ইতিহাস নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও পলাশীর ষড়যন্ত্র অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলচনা করতে গেলে পলাশীর ষড়যন্ত্রের সম্যক বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি।  


স্কুল-কলেজের পাঠ্য পুস্তকই শুধু নয়, এস. সি. হিল থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল, ক্রিস গেইলি, রজত কান্ত রায় প্রমুখের গ্রন্থেও সিরাজউদ্দৌলা এবং পলাশী ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন মত ও বক্তব্য দেখা যায়।


পাটনা থেকে খবর আসে পাটনার লোকেরা মুর্শিদাবাদ পালানোর জন্য নৌকা যোগাড় করছে। অন্যদিকে বিহারের নায়েব রামনারায়ণকে নাকাল করতে পাটনার দক্ষিণে, নরহত সিমাই অঞ্চলের লড়াকু জমিদার কামগর খান বিদ্রোহ করেছেন। রাম নারায়ণ পড়লেন মহাফাঁপরে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছে তিনি সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। অন্যদিকে চন্দননগর বিজেতা ক্লাইভ নবাবকে মসিয়ে ল এবং অন্যান্য পলাতক ফরাসিদের আশ্রয় দেবার জন্য নানা হুমকি দিচ্ছেন আর ভয় দেখাচ্ছেন তাদের ধরার জন্য কাশিম বাজারে এখনই ফৌজ পাঠাবেন।


সব ভেবে চিন্তে নবাব নিজের টাকায় মসিয়ে ল কে শুধু পাটনা রওনা করিয়ে দিলেন। ইংরেজদের কানে খবর পৌঁছালো মসিয়ে ল নবাবী মাইনেতে আপাতত কামগড় খান কে শায়েস্তা করতে রামনারায়ণের কাছে যাচ্ছেন। নবাবী মাইনের ব্যাপারটা সত্য কিনা জানতে ওয়াটস জগৎশেঠের কাছে গেলেন। জগৎশেঠ ইংরেজদের মিত্র বটে কিন্তু তিনি ফরাসিদেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।  খবরটা সত্য হলেও জগৎশেঠ সেটা কখনও মানতেন না। 


যাবার আগে মসিয়ে ল নবাবকে বলে গিয়েছিলেন দরবারে নানা ষড়যন্ত্র চলছে নবাব যেন সাবধানে থাকেন।  সিরাজ কথাটা হেসে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন যে এ খবর সত্যি না হয়ে যায় না। ষড়যন্ত্র যে শুরু হয়ে গিয়েছিল তার একটা প্রধান ও অন্যতম লক্ষণ মোহনলালকে অজ্ঞাত আততায়ী কর্তৃক বিষ প্রয়োগ।


(Transition & Music Change)


এখানে একটা কথা বলা দরকার, ইংরেজরা যখন চন্দননগর চড়াও হয় তখনও কিন্তু মীরজাফরের মাথায় সুবাদার হওয়ার পরিকল্পনা ঢোকেনি। উপরন্তু বলা যায় মসিয়ে ল তার কাছেও সাহায্য ভিক্ষা করতে গিয়েছিলেন এবং মীরজাফর তার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। এমনকি সাহায্য করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ বোঝা যায় তখনও ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফরের গুপ্ত যোগ সূত্র স্থাপিত হয়নি । সেই ঘটনা ঘটে ল বিদায় নেওয়ার পরে।


ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ইংরেজদের রাজদূত হয়ে ওয়াটস মুর্শিদাবাদে আসে এবং তার ধারণা হয় প্রতিপক্ষ ল টাকা দিয়ে দরবারে অনেক লোককে হাত করেছেন। তখন তিনিও সেই খেলায় নামেন। ইংরেজ ও ফরাসি দুই পক্ষই টাকা দিয়ে দরবারে নিজ নিজ দল ভারি করতে থাকে। কিন্তু ইংরেজদের টাকার জোর অনেক অনেক বেশি। মসিয়ে ল ঠিক কায়দা করে উঠতে পারলেন না। এমন সময় ঢাকার ইংরেজ কুঠির সাহেব লিউক স্ক্র্যাপটন নবাবী ফৌজ কর্তৃক ঢাকা কুঠি লুঠের ক্ষতিপূরণের হিসাব নিকাশ বুঝে নিতে মুর্শিদাবাদে পৌঁছে দেখলেন, দরবারে যেসব লোককে ল টাকা দিয়ে বশ করার চেষ্টায় ছিলেন তারা আস্তে আস্তে আরো বেশি টাকার লোভে ইংরেজদের দিকে চলে আসছে। আর তাদের কাছ থেকে ওয়াটস গোপনীয় খবরা-খবর সব সংগ্রহ করে নিচ্ছে। ক্লাইভের গোপন নির্দেশ ছিল দরবারে চেহারাটা অনুধাবন করে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বী কোন সরকার গঠন করা সম্ভব কিনা তা যাচাই করা। তাই তিনি উপরওয়ালার ওয়ালশ সাহেবের কাছে দরবারের খবর দিয়ে চিঠি দিতেন এবং ওয়ালশ সাহেবের থেকে ক্লাইভ এর হাতে সেই চিঠি পৌঁছাত। 


                             


মুর্শিদাবাদ থেকে মসিয়ে ল বিদায় নেবার পর ইংরেজদের দল অপ্রতীহত হয়ে ওঠে এবং দলাদলির চেহারাও পাল্টে যায়।  যাবার আগে ল ইংরেজ এবং জগৎশেঠদের জল্পনা কল্পনায় যে প্রধান সমস্যা লক্ষ্য করে গিয়েছিলেন তা হল এমন একজন উপযুক্ত আমীর খুঁজে বের করা যাকে সবাই মানবে এবং যিনি সিরাজের বিকল্প নবাব হতে পারবেন। শওকত জং মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন ধরে কটকের নবাব নামে পরিচিত মারাঠাদের আশ্রিত উড়িষ্যার নায়েব নাজিম মির্জা সালেহের নাম শোনা যাচ্ছিল তিনি নাকি মারাঠাদের সহায়তায় মুর্শিদাবাদ আসছেন। তাছাড়া শওকত জং এর একজন ছেলে এবং ভূতপূর্ব নিহত নবাব সরফরাজ খানের পাঁচ ছেলেকে নিয়েও মুর্শিদাবাদে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। তাতে সিরাজ এতই ভয় পেয়েছিলেন যে মসিয়ে ল বিদায় হবার পূর্ব মুহূর্তে তিনি ঢাকা থেকে দুশো বক্সরী ও পিয়নের পাহারায় আগা বাবু। আমীনি খান, মীর্জা মোগল, শুকুরুল্লাহ খান এবং সরফরাজ খানের কনিষ্ঠ শিশু পুত্র- এই পাঁচ ভাইকে নৌকায় চাপিয়ে মুর্শিদাবাদ আনতে হুকুম দেন । 


একাংশ ঐতিহাসিকদের দাবি, পলাশীর ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই এ কাজ সম্পন্ন করে এবং নানা প্রলোভন দেখিয়ে ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয় পলাশী যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজউদ্দৌলাকে হটিয়ে অন্য কেউ মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে। তবে এটাকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষ স্খালনের প্রচেষ্টা হিসাবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। নবাবের দরবারে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা অংশ সিরাজউদ্দৌলার উপর বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করার চেষ্টা করছিল একথা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।


তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এর বক্তব্য, পলাশী ভারতীয়দের চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র। এর পেছনে ইংরেজদের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। প্রথম দিকে ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল খুবই সীমিত কিন্তু তারা যখন উপলব্ধি করে যে মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সিরাজউদ্দৌলাকে হটাতে উৎসুক, তখন তাদের লক্ষ্য আস্তে আস্তে প্রসারিত হয়। সাধারণভাবে পলাশীর ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত মীরজাফরকেই দায়ী করা হয়। মীরজাফরই বিশ্বাসঘাতক। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে হটিয়ে বাংলার মসনদ অধিকার করার মতলবে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে পলাশীর চক্রান্তে যোগ দেন এই মত বহুল প্রচারিত। 


কিন্তু আলীবর্দী খানের কাছে কোরন শরীফ ছুঁয়ে, যে সেনাপতি শপথ করেছিলেন নবাবের নাতিকে তিনি রক্ষা করবেন সেই মীরজাফর শপথ ভঙ্গ করার কথা প্রথমে চিন্তা করেনি। তার সাহায্য ছাড়া সিরাজ কোনদিনই নবাব হতে পারতেন না। তিনি তরুণ নবাবকে এতদিন তখতে বজায় রেখেছিলেন। নবাব নিহত হবার পর তার মাথায় নিজে নবাব হওয়ার পরিকল্পনা জেগে ওঠেনি। কিন্তু বার বার দরবারে অপমানিত হতে হতে তার সহ্যের সীমা ছিঁড়ে যায়। অন্যদিকে বিষাক্রান্ত মোহনলাল সুস্থ হয়ে শিগগিরই দরবারে ফিরে আসবেন এই ভয় কাজ শুরু করে তাঁর মনে।


তারপর কি করেছিলেন সৈয়দ মীর জাফর আলী খান? সেই কাহিনী শোনাবো পরের পর্বে।






Comments

Popular posts from this blog

হারানো এক জয় সেবাস্টিয়ান আর কলকাতার গপ্পো ❤️

জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ১৭২ বছর

৩ মাস ধরে জ্বলেছিল এই পৃথিবী সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯তলা গ্রন্থাগার!