মীরজাফর কি বাধ্য হয়েছিল পলাশির ষড়যন্ত্র করতে? দ্বিতীয় পর্ব
মীরজাফরই শুধু বিশ্বাসঘাতক বলে জনমানুষে যে ধারণা প্রচারিত হয়ে আছে তা ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য?
আজ দ্বিতীয় পর্ব। এই ভিডিওর আগের পর্বে আমরা যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি তা হল -
মীরজাফর কি বাধ্য হয়েছিলেন পলাশী ষড়যন্ত্র করতে?
পলাশী চক্রান্তের মূল নায়ক কে বা কারা?
মীরজাফরই শুধু বিশ্বাসঘাতক বলে জনমানুষে যে ধারণা প্রচারিত হয়ে আছে তা ঐতিহাসিকভাবে কতটা সত্য?
পলাশী কি শুধু ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র এটি ইংরেজদের কি কোন ভূমিকা ছিল না?
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছি এবং যা পেয়েছি তা উপযুক্ত প্রমাণসহ তুলে ধরর এই ভিডিওতে কিন্তু মূল পর্বে যাওয়ার আগে, ইতিহাসের নানা অজানা কাহিনী জানতে, subscribe করুন এই চ্যানেলটিকে।
দেওয়ান সুবাহ মোহনলাল দরবারে ফিরে আসা মাত্র নিত্যনতুন অপমানের ধাক্কায় মীরজাফর ও নিজামত দেওয়ান রায় দুর্লভ এর প্রাচীন বন্ধুত্ব পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। আলীবর্দী খানের আমলে সওয়ার হাজিরা সংক্রান্ত কারচুপি ও তছরুপ ধরা পড়ে যাওয়ার সময় বিপর্যস্ত বকশী রায় দুর্লভ সাহায্য নিয়েছিলেন এবং সেই সুবাদে ওই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। মোহনলাল এই দুজনেরই শত্রু। দুই পুরাতন বন্ধু আবার একজন আরেকজনের সহায়তা করতে লাগলেন। এরা ছাড়াও দরবারে রহিম খান বাহাদুর আলী খান ইত্যাদি আলীবর্দী খানের আমলের পুরনো কয়েকজন মনসবদার ছিলেন এরাও একে একে মীরজাফর ও রায় দুর্লভের দলের সঙ্গে হাত মেলালেন।
দরবারে টাকা ঢেলে ওয়াটস ও ল পরস্পরের বিরুদ্ধে দল গঠনের কুটচাল তখন ব্যাপৃত। ক্লাইভ তখত উল্টানোর ব্যাপারে তখনও প্রবৃত্ত হননি, তবে সেই চিন্তা তার মনে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। লন্ডনে সিক্রেট কমিটির কাছে তিনি জানালেন, “চুক্তি ভঙ্গ করতে আমার ইচ্ছা নেই কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী সবকিছু আদায় না হলে সে ছাড়া উপায় থাকবে না এবং হয়তো কিছুটা উত্তর দিকে কুচ করে অগ্রসর হলেও ফল ফলবে।”
দো হাজারি মনসবদার ইয়ার খান লতিফ সম্প্রতি আশাহত হয়েছিলেন। কারণ নবাব প্রায় ঠিক করেছিলেন তাকে নন্দকুমারের জায়গায় হুগলির প্রবেশদ্বার করবেন। কিন্তু কোন কারনে সেটা আটকে যায়। লতিফের সঙ্গে ইংরেজদের তখনও যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। ওয়াটস সবে দরবারে পৌঁছে ঘুষ দিয়ে তখন নন্দকুমারকে স্থায়ীভাবে হুগলী প্রবেশদ্বার বানাবার পরিকল্পনা করছেন।
উমিচাঁদের কাছ থেকে কথাবার্তায় তিনি ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন নবাবের বিরুদ্ধে একটা বিপক্ষ দল তৈরি হয়েছে। তারা অন্য কাউকে ডাকতে বসাতে চায় তখতে। অন্যদিকে ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে বারবার লিখছেন তিনি বর্ষার পরেই সৈন্য সমেত ফিরে আসছেন চুক্তির শর্তগুলি আদায় করবার জন্য। উত্তর দিকে একটু এগোতে তৈরি থাকলেও তিনি তখনও শান্তি ভঙ্গ করতে মোটেই উৎসুক নন। এমতাবস্থায় স্ক্র্যাপটন মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছালেন। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওয়াটস বুঝলেন দরবার থেকে যেসব বার্তা আমীরচাঁদ বয়ে আনছেন ইংরেজ শিবিরে সেই দিকেই হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
পলাশীর ষড়যন্ত্রে মুর্শিদাবাদ দরবারে অভিজাত বর্গের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মীরজাফর ও জগৎশেঠ। যদিও উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ এতে জড়িত ছিলেন তাই মীরজাফর-ই একমাত্র বিশ্বাসঘাতক এটা সত্য নয়। জগৎশেঠের ভূমিকাও ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় ইংরেজরা নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বাসাবার মতলব করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তাঁরা জানত জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোন রাজনৈতিক পালা বদল সম্ভব নয়। কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ যিনি দরবারের নারী নক্ষত্রের খবর রাখতেন, তিনি পরিষ্কার লিখেছেন যে, “ইংরেজরা যা করছে তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া তারা করতে কখনো ভরসা পেত না।” সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীরজাফরের নয় জগৎশেঠদের দায়ও মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয় ।
আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সবকটা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই সময়কার রাজনীতিতে পদ পরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদের হাতে। জাঁ ল’ লিখছেন “অনেকদিন ধরে বাংলার যেসব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিলেন তারাই” অর্থাৎ জগৎশেঠরা। ক্লাইভ এর লেখা চিঠি পত্র পড়েও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে পলাশী চক্রান্তে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদত পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন জাঁ ল’ও মন্তব্য করেছেন যে “মোহনলাল যদি সুস্থ থাকতেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতার রহিত না হতেন, তাহলে পলাশির চক্রান্ত অত সহজে সফল হতো না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য মোহনলাল কিছুদিন ধরে এবং বিশেষ করে চরম বিপদের এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন”। ল মনে করতেন যে মোহনলাল জগৎশেঠদের পরম শত্রু এবং তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারার মতন একমাত্র ব্যক্তি।
যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ইংরেজরাই পলাশী চক্রান্তে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, তাহলে যে প্রশ্ন আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং যা একমাত্র সুশীল চৌধুরী তাঁর “নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ” বইতে করেছেন, তা হল - এই চক্রান্ত ইংরেজদের পক্ষে এত জরুরী হয়ে পড়েছিল কেন? তার প্রধান কারণ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করা। সমসাময়িক নথিপত্র ও দলিল দস্তাবেজ পরীক্ষা করে দেখলে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটা স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাবে। এসব কর্মচারীরা সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এদেশে আসতো একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি প্রচুর ধন উপার্জন করে দেশে ফিরে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। বাংলায় কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা ছিল ১৭৩০ দশক ও ৪০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তারপরে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর কারণ একদিকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য এ সময় অভাবনীয় উন্নতি এবং অন্যদিকে হুগলির আরমানি বণিক খোঁজা ওয়াজিদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার। ফরাসিদের সঙ্গে আবার ওয়াজিদের বোঝাপড়া থাকার ফলে ইংরেজরা খুব অসুবিধা মধ্যে পড়ে যায় এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই বাংলা বিজয় করতে চেয়েছিল এবং সেজন্য পলাশী চক্রান্ত ইংরেজদের পক্ষে জরুরী হয়ে পড়ে বলে সুশীল চৌধুরী তাঁর বইতে লিখছেন।
১৭৫০ এর দশকের প্রথমদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা যে নিদারুণ সংকটে পরে তা কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট অরুম, কলকাতার এক ইংরেজ বাসিন্দা ক্যাপ্টেন ফেনউকের লেখা ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের আলাপ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাছাড়াও ডাজ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় আসা যাওয়া করা জাহাজের যে তালিকা পাওয়া যায় তা থেকে আমাদের বক্তব্যের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে। ১৭৫৪ সালে যেসব ইংরেজ জাহাজ এসেছিল তার মোট সংখ্যা ২০। এরমধ্যে ১২ টি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র ৮টি যারা ব্যক্তিগত ব্যবসা করতো তাদের। অন্যদিকে ওই বছরই বাংলায় ফরাসি জাহাজ এসেছিল ২৭ টি তার মধ্যে ২২ টি ব্যক্তিগত ব্যবসাতে লিপ্ত, আর মাত্র পাঁচটি ফরাসি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ। আবার টানেজের হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৫১ সালে ছিল ৭৪২০ টন। তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার আর ১৭৫৪ তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন, এরমধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী লিপ্ত জাহাজের টানে জের পরিমাণ ৭৪৫০ টন। এই পরিসংখ্যান থেকেও এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যে যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসা যথেষ্ট ক্ষতি হয়।
সিরাজউদ্দৌলা নবাব হওয়ার পরে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা আরো বেশি সংকটের মুখে পড়ে। কারণ এই প্রথম তরুণ নবাব ইংরেজদের দ্বর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেন, যে তিনি এই বেআইনি ব্যবসা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কর্মচারীরা তাদের এই লাভজনক ব্যবসা ছাড়তে একেবারেই নারাজ ছিল। তাই তারা তাদের সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতরণ ও অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হটিয়ে অন্য কাউকে বসাবার পরিকল্পনা করে। এজন্য রাজ্য জয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেজন্যই পলাশীর ষড়যন্ত্র। তাতে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য দূর করা সম্ভব হবে উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, ব্যবসায়ী-সওদাগর, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের উপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। একথা শুধু যে পশ্চাৎ সমীক্ষাতে ধরা পড়েছে তা নয় কোম্পানির লেখা ও কাজ কর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড ও ম্যানিংহ্যামের এর ক্লাইভকে লেখা চিঠি, কোম্পানির পণ্য সরবরাহে দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখো মনোভাব এসবই - ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তার নির্দেশক।
মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কি হবে তা কলকাতার সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার বলেছিলেন যে, কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা যুক্তির শর্তাবলীতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যাপারটা চালু করেছিল’ অর্থাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে হটিয়ে মীরজাফরকে বসানোর পরিকল্পনা। এসব থেকে ইংরেজদেরও অভিপ্রায় সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। আবার এও বলা যায়, ইংরেজরা চক্রান্ত সংগঠিত করতে শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদগ্রীবও হয়ে পড়েছিল।
২২শে জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী পলাশী অভিমুখে অভিযান শুরু করে। কিন্তু সেই দিনই সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তার সঙ্গে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লেখেন। তাতে লেখা ছিল - “যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমরা স্থির প্রতিজ্ঞ আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব আপনি যদি পলাশীতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তাহলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে আপনাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারি। আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এটার উপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই ওরফে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা সুবাদার বা নবাব হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এত একটু না করেন তাহলে ভগবান আপনার সহায় হোন। আমাদের কিন্তু পরে বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।”
মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কি ধরনের প্রলোভন এবং অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২শে জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছালো এবং বিকেলে ক্লাইভ পলাশির অভিমুখে অভিযান করার সিদ্ধান্ত মীরজাফর কে জানিয়ে দিলেন। এদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার অবস্থা বেশ কাহিল। অস্থির চিত্র ও বিপদের সময় বিহ্বল হয়ে পড়াটা তার স্বভাবের অন্তর্গত এবং তার অন্যতম দুর্বলতা। অবশ্যই এটা মনের না রাখলে তার প্রতি অবিচার করা হবে যে তখন কতগুলি ঘটনা তাকে বিভ্রান্ত করেছিল।
এ সময় তার দৃঢ়সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের কতগুলো কারণও ছিল। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই আহমেদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে বাংলায় আফগান আক্রমণের আশঙ্কা তার কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক করে হোক বা ভুল করেই হোক তিনি ভেবেছিলেন ইংরেজদের চাইতে আফগানরাই তখন বড় বিপদ। তাই তিনি তার সৈন্য বাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ অংশকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে বিহারের সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে তাঁর দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ও ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় তিনি বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই সম্ভবত যারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে বলে সন্দেহ করেছিলেন তাদের সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তখনও তাঁর আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফর ও তার সঙ্গী অন্যান্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনরকম চরম ব্যবস্থা না নিয়ে বিরাট ভুল করেছিলেন। এটা লিউক স্ক্র্যাপটন এবং জাঁ ল’ ও স্পষ্ট ভাষাতে জানিয়েছেন। অথচ সিরাজের অনুগত সেনাপতিরা বিশেষ করে মীরমদন, আব্দুল হাদী খান প্রমুখ তাকে বারংবার অনুরোধ ও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে মীরজাফর ও তার সঙ্গী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা নিলে ইংরেজরা আক্রমণ করতে কোনমতেই সাহস করবে না কিন্তু নবাব দাঁতে কর্ণ পদও করলেন না, তিনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশীতে ইংরেজদের মুখোমুখি হলেন ২৩শে জুন।
পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর রায় দুর্লভ ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মত নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২৩ শে জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়ালো, তা দেখে স্ক্র্যাপটন হতবাক। পলাশীতে নবাবের শিকারগৃহের ছাঁদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন। সকাল ৮টা নাগাদ যুদ্ধ শুরু হলো। ষড়যন্ত্র সত্বেও নবাবের সৈন্য বাহিনী তার অনুগত ও দক্ষ সেনাপতি মোহনলাল, মীরমদন, খাজা আব্দুল হাদী খান, নবসিংহ হাজারী প্রমুখের নেতৃত্বে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন আর সাঁ ফ্রের অধীনে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনী ও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা ক্লাইভ এর কাছে খুব আশা পূর্ন মনে হলো না। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন, তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের সৈন্যরা এবং সেনাপতিরা তার ওপর বীতশ্রদ্ধ। তাই তারা ইংরেজদের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তিনি যা দেখছেন তা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। পলাশীর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জন উড নামে এক ইংরেজ সৈনিক লিখছেন- “সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশা জনক এবং রাত হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করছিল যাতে অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়া যায়।” ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপদজনক ও খারাপ তা ওয়াটস এর লেখা থেকেও স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন, নবাব বা তার সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তাহলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে অপদস্ত করতে পারতো। তা হলে ক্লাইভকে রাতের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো।” ক্লাইভ আসলে তা ভেবেই রেখেছিলেন।
যুদ্ধ চলতে লাগল। নবাবের সৈন্যবাহিনী তার অনুগত সেনাপতিদের নেতৃত্বে অসম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে পলাশীর আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজ ফৌজের দিকে এগোতে লাগল। বেলা তখন প্রায় তিনটে। ফরাসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছিল। ঠিক এই সময় দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ একটি গোলার আঘাতে মীরমদন গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। তাকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর, তার মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোর একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাপটন লিখছেন- “আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীরমদন নিহত হন”। এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজউদ্দৌলা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দেন ওই দিনের মতন যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে এবং এই খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ কেও জানিয়ে দিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায় দুর্লভকেও ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই পরামর্শ দিলেন। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব, মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীরমদনের মৃত্যুর পর মোহনলাল মূল সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেনাপতিদের সকলেই প্রথমে নবাবের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন এই যুক্তিতে, যে ওই সময় ফিরে আসা অত্যন্ত বিপদজনক হবে। কিন্তু সিরাজের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। ইউসুফ আলী লিখছেন, “ওই সময় যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে তাদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেয়ার জন্য নবাবের অন্যতম সেনাপতি মীর মোহাম্মদ কাজিম বেশ করা ভাষায় নবাবকে ভৎর্সনা করতেও দ্বিধা করেননি।”
সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যরা পিছু হটতেই ইংরেজরা তাদের উপর ঝাপিয়ে পরে এবং তাতে নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশীর তথাকথিত যুদ্ধ শেষ। সন্ধ্যা ৬টায় ক্লাইভ মীরজাফরের অভিনন্দন সূচক বার্তা পেলেন। তাতে লেখা, “আপনার পরিকল্পনা সফল হওয়ায় অভিনন্দন গ্রহণ করুন”। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন “আপনার” অর্থাৎ ইংরেজদের পরিকল্পনা। ক্লাইভ পরের দিন জুন স্ক্র্যাপটন মারফত দাউদপুর থেকে মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন। “এ জয় আপনার আমার নয়। অতিসত্বর আমার সঙ্গে মিলিত হলে খুশি হব। আপনাকে নিয়েই কালই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করব। আশা করি আপনাকে নবাব বলে ঘোষণা করার সম্মান আমি পাব।” ক্লাইভই মুর্শিদাবাদের মসনদে মীরজাফরকে বসিয়ে তার মাথায় নবাবের মুকুট পরিয়ে দেন।
অতএব আমরা যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম যে “মীরজাফর কি বাধ্য হয়েছিলেন পলাশির ষড়যন্ত্র করতে?” তা খুঁজতে গিয়ে আমরা যা পেলাম তা হল, মীরজাফর পরোক্ষ বা প্রতক্ষ্যভাবে বা লোভে পরে নবাবে বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। তবে তিনি একা নন। এখানে মুখ্য ভুমিকা পালন করেন জগৎশেঠ পরিবার। কারণ তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেখতে গেলে দেখা যাবে, জগৎশেঠদের সাহায্য ছাড়া বাংলায় কোন রাজনৈতিক পালা বদল সম্ভব ছিল না। ইংরেজরা যা করছিল তা জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া তারা করতে কখনোই করতে পারত না সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীরজাফরের নয় জগৎশেঠদের দায়ও মীরজাফরের চাইতে বেশি বই কম নয় ।
অন্যদিকে নবাব সিরাজদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সিরাজদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসাকে নিয়ে রাজধানী থেকে বেরিয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সৈনিকদের সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। আবার মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। তারপর কি হল? সেই গল্প শোনাবো অন্য এক পর্বে।

Comments
Post a Comment